উপরের (এর আগের কিস্তিতে প্রকাশিত) চিঠিতে আমার আর নতুন করে জোড়ার কিছুই নেই - এটা নিজেই সব বলে দিয়েছে; তবে তখন আমি ভেবেছিলাম যে এটা আমার সাফল্যের সব থেকে বড় প্রমাণ। আমার নিজের কথা বলতে, আমার তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে এক বিন্দুও মাথাব্যথা নেই, একমাত্র যতক্ষণ না যে সংবাদপত্র আমাকে এই অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল, তারা সেই বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে। তবে একথা সত্যি যে তাঁর ভ্রমণের ফলাফল সম্পর্কে কৌতূহল ছিল; তবে, তিনি যখন স্বীকার করেছেন যে তাঁর শুরু করা কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি, তখন থেকে আমি স্বেচ্ছায় যতটুকু বলেন তার বেশি এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কুণ্ঠাবোধ করেছি। ... ...
প্রিয় স্যার - সাধারণতঃ অদেখা কাউকে চিঠি লেখাটা খানিকটা কঠিন কাজ - অনেকটা কোন একটা বিমূর্ত ধারণাকে সম্বোধন করার মতই বলা যায় - তবে আপনার প্রতিনিধি, মিঃ এইচ এম স্ট্যানলির, এই দূরের দেশে উপস্থিতি আপনার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়েছে। উনি না এলে আমি অবশ্যই এই চিঠি লিখতে কিন্তু কিন্তু করতাম। তবে ওঁকে পাঠিয়ে আপনি যে অসীম দয়া দেখিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখতে খুবই স্বচ্ছন্দ বোধ করছি। ... ...
আমি ডাক্তারকে শেখ সাইদের কাছে লোক পাঠানোর জন্যও অনুরোধ করলাম। তার কাছে এটা জানতে চাওয়ার দরকার যে ডাক্তার উজিজিতে প্রথম বার পৌঁছানোর পরে ডাঃ কার্ক ও লর্ড ক্ল্যারেনডনের জন্য যে দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেটা তিনি পেয়েছেন কিনা; আর ডাক্তার যেমন চেয়েছিলেন, সেইমত তিনি চিঠিদুটো উপকূলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিনা। দূত এসে খবর দিল যে হ্যাঁ পাঠানো হয়েছে। পরে ডাক্তারের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করেও একই উত্তর পেয়েছি। ... ...
উন্যানিয়েম্বে জায়গাটা এখন আমার কাছে মাটির পৃথিবীতে স্বর্গের মতন। লিভিংস্টোনও কম খুশি নন; তিনি একটা আরামদায়ক ঘরে ছিলেন, উজিজিতে তাঁর কুঁড়েঘরের তুলনায় সেটা একটা রাজপ্রাসাদ। আমাদের ভান্ডারের জিনিসপত্র এসেছে বাগামোয়ো থেকে, দেড়শও বেশি কুলির মাথায় চেপে। কাপড়, পুঁতি, তার ও হাজার-একটা ভ্রমণ সংক্রান্ত লটবহর তো আছেই। এছাড়াও অজস্র ঐহিক বিলাসদ্রব্যে ভরা সে ঘরগুলো। আমারই পঁচাত্তর বস্তা হরেক রকম জিনিস আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান দ্রব্য সামগ্রী এখন লিভিংস্টোনের হাতে তুলে দেওয়া হবে, নীল নদের উৎসের দিকে তাঁর অভিযানের জন্য। ... ...
পরের দিনেও আমরা ওখানেই ছিলাম, এখানে এত বিভিন্ন রকমের পশুর সমাবেশ যে শিকারের পিছনে ধাওয়া করার জন্য আমি খুবই উৎসুক। সকালের কফিপানের পর আমার বন্ধু সেই অ্যামোনিয়া-বোতল খ্যাত মামান্যারার জন্য উপহারসহ কয়েক জনকে পাঠানো হল। তারপরই আমি আরও একবার মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। শিবির থেকে পাঁচশো গজ দূরেও যাইনি, হঠাৎ আমি ও আমার দলবল খুব কাছেই, সম্ভবত পঞ্চাশ গজ বা তার চেয়েও কম দূরত্বে, একটা সমবেত গর্জন শুনে থেমে গেলাম। ... ...
যদিও উপরে বলা এইসব ভাল ভাল জিনিসের আমাদের অভাব ছিল, তবু আমাদের কাছেও লবণে-জারানো জিরাফ ও জেব্রার জিভের আচার ছিল; হালিমাহের বানানো উগালি ছিল; এছাড়া মিষ্টি আলু, চা, কফি, ড্যাম্পার বা স্ল্যাপজ্যাকও ছিল; কিন্তু সেসব খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গিয়েছিল। আমার দুর্বল পেট, বিভিন্ন ওষুধ, ইপিকাপ, কোলোসিন্থ, টারটার-এমেরিক, কুইনাইন এইসব খেয়ে খেয়ে বিরক্ত, কাতর। এইসব হাবিজাবি খাবারের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করছিল। "ওহ, একটা গমের রুটি!" আমার মন কাঁদছিল। "একটা রুটির জন্য পাঁচশ ডলারও দিতে পারি!" ... ...
সামনের ডান পায়ের খুর থেকে তার মাথার উপর প্রান্ত অবধি জিরাফটা মাপে ১৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। এই গোত্রের সবচেয়ে বড় আকারের গুলোর মধ্যের একটা। যদিও এক একটা ১৭ ফুটের বেশি মাপেরও পাওয়া গেছে। সারা গায়ে বড় কালো, প্রায় গোল গোল দাগ। খামিসিকে মৃত জন্তুর দায়িত্ব দিয়ে আমি শিবিরে ফিরে গেলাম। সেখান থেকে লোক পাঠাতে হবে জিরাফ কাটা ও আমাদের গ্রামে মাংস বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু খামিসি সিংহের ভয়ে একটা গাছে উঠে বসেছিল আর সেই ফাঁকে শকুনের দল জিরাফের উপর এসে বসেছিল। ... ...
২০ জানুয়ারি, ১৮৭২। আজ আমাদের যাত্রা স্থগিত ছিল। শিকারের জন্য বেরোতে গিয়ে দেখি এগারোটা জিরাফের একটা পাল। এরকম একটার চামড়া পেলে কী ভালই না হত! এমপোকওয়া নদী পেরিয়ে আমি তাদের একজনের দেড়শ গজের মধ্যে আসতে পেরেছিলাম আর এটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাই; কিন্তু, এটা আহত হলেও, পেড়ে ফেলতে পারিনি। ... ...
দশম দিন সকালে আমি দলের সবাইকে আশ্বস্ত করলাম যে আমরা খাবারের কাছেই আছি; অঢেল খাবারের প্রতিশ্রুতি তাদের মধ্যে বিনীতদের উত্সাহিত করেছিল। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না নিতেও সতর্ক করা হয়েছিল - পাছে আমি রাগের মাথায় মেরে বসি! তাতে সবথেকে পাজিগুলোকে চুপ করানো গিয়েছিল। তারপর বনের মধ্য দিয়ে উত্তর-ঈশান দিক বরাবর চললাম। ক্লান্ত মানুষের দল দুর্বলভাবে, বেদনাদায়কভাবে আমার পিছু নিল। খুবই বেপরোয়া অবস্থা তখন, বেচারাদের নিজেদের জন্য যতটা না দুঃখ হচ্ছিল, আমার তার চেয়েও বেশি করুণা হচ্ছিল; আর তারা হাল ছেড়ে শুয়ে পড়লে তাদের সামনে প্রচুর রাগারাগি চেঁচামেচি করলেও, তাদের গায়ে হাত তোলার কথা তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। তাদের জন্য খুবই গর্বিত ছিলাম; কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে এটা খুবই বিপজ্জনক ছিল। ... ...
এই উপত্যকাগুলোর মধ্যে একটাতে এইদিন আমরা লালচে দাড়িওয়ালা বানরদের একটা দলের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কাফেলা দেখে তাদের চিৎকার, চেঁচামেচি গোটা এলাকা জুড়ে শোনা যাচ্ছিল। তারা গাছ বেয়ে তরতরিয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছিল আর চেঁচিয়ে-মেচিয়ে যেন যুদ্ধের ডাক দিচ্ছিল - ফলে তাদের কাছে ঘেঁষতে পারিনি। তবে তারপরেও আমাদের এগিয়ে যেতে দেখে তখন আবার মাটিতে নেমে এলো; ওদের পিছনেই পড়ে থাকতাম যদি না হঠাৎ মনে পড়ত যে আমার অনুপস্থিতি আমাদের অভিযানকেও থামিয়ে রেখেছে। ... ...
পরের দিন আমাদের কিরাঙ্গোজির নির্দেশ মেনে পূর্ব দিকে এগোলাম; তবে যে রাস্তা দিয়ে সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল তার থেকে এটাও বোঝাই যাচ্ছিল, যে সে এই দেশটার কিছুই জানে না। যদিও সে এতই বকর বকর করছিল যে মনে হবে যেন সে এনগোন্ডো, ইয়ম্বেহ এবং পুম্বুরুর এলাকাগুলোর সম্বন্ধে একদম দিগগজ পণ্ডিত। কাফেলার মাথার দিক থেকে আমাকে ডাকা হল। তখন আমরা সিধা লোয়াজেরির খর স্রোতে নামতে যাচ্ছি, আর সেটা পেরলেই তিন থাক দুর্গম পর্বতমালা, সেগুলোকে উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে পেরোতে হবে। মোটেই আমাদের নির্দিষ্ট পথের দিকে না সেটা। ... ...
উরিম্বা কাওয়েন্দির একটা বড় জেলা। যদিও একই নামের একটি গ্রামও রয়েছে - সেখানে ইয়োম্বেহের থেকে পালিয়ে আসা লোকেরা থাকে, তারা লোজেরির ব-দ্বীপে বাসা বেঁধেছিল। যদিও রুসিজির দ্বীপের মতোই অস্বাস্থ্যকর জায়গা, তবু তাদের মনে হয়েছিল দক্ষিণ কাওয়েন্দির সুলতান পুম্বুরুর এলাকার আশেপাশের থেকে অনেক বেশি যুতসই। বিজয়ীদের ভালমতো তাড়া তাদের অভ্যাস নাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হল, কারণ তারা খুব ভীতু আর অপরিচিতদের প্রতি ঘোর অবিশ্বাসী, কোনমতেই তাদের গ্রামে আমাদের ঢুকতে দিল না। অবশ্য সত্য বলতে, যে পচা গলা জায়গাটার উপর তারা আস্তানা গেড়েছিল, সেদিকে এক ঝলক দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার ধারণা যে একদম ওই এলাকায় —না, দু'পাশেই কয়েক মাইল জুড়ে —একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের পক্ষে এক রাত ঘুমানো মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। গ্রামের দক্ষিণে যাওয়ার পথে, আমি টংওয়ে উপসাগরের শেষতম দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, কিভাঙ্গা বা কাকুঙ্গু পাহাড়ের উঁচু চুড়ো থেকে প্রায় দেড় মাইল পশ্চিমে একটি উপযুক্ত ক্যাম্পিং-এর জায়গা পেলাম। ডাক্তার যা মাপজোক নিলেন সেই অনুসারে আমরা ৫° ৫৪' দক্ষিণ অক্ষাংশে অবস্থান করছিলাম। ... ...
পরের দিনটা কাটল মালাগারজির মুখের বিস্তীর্ণ জলরাশি পেরিয়ে কাফেলার সবকিছু নদীর কয়েক মাইল উত্তরে আমাদের শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কাজে। এই নদীটা এমন একটা নদী যেটা সভ্য মানুষেরা ট্যাঙ্গানিকা থেকে উপকূলের দূরত্ব কমানোর জন্য খুব সুবিধাজনক হিসেবে দেখবেন। এই নদী বেয়ে প্রায় একশ মাইল চলে যাওয়া যায়, আর এটা সমস্ত ঋতুতেই যথেষ্ট গভীর থাকে - ফলে উভিনজার কিয়ালা পর্যন্ত সহজেই চলে যাওয়া যায়। আর সেখান থেকে উন্যানয়েম্বে অবধি একটা সোজা রাস্তা সহজেই বানিয়ে ফেলা যায়। মিশনারিরাও ধর্মান্তরের জন্য এলে উভিনজা, উহহা ও উগালায় যাওয়ার জন্য এখান থেকে একই সুবিধা পেতে পারেন। ৩০ তারিখে আমাদের পথ ধরে, কাগঙ্গো, এমভিগা ও কিভোয়ের মনোরম অন্তরীপগুলিকে পেরিয়ে, প্রায় তিন ঘণ্টা নৌকা বাওয়ার পরে খরস্রোতা ঘোলা জলের ইউগুফুর মুখের গ্রামগুলো আমাদের চোখে পড়ল। এখানে আবার আমাদের কাফেলাকে কুমির-বোঝাই নদীর মোহনা পেরোতে হয়েছিল। ... ...
যাত্রা শুরু করলাম সকাল আটটায়। আরবরা ছিল। আর তাদের সঙ্গে ভিড় জমিয়েছিল যত উটকো কৌতূহলী লোকের দল। সবাই হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল। আমরাও তাদের সবার দিকে হাত টাত নেড়ে বিদায় জানালাম। দু-একটা লোক বিশেষত মোহাম্মদ বিন সালির মতন প্রমাণিত বদমাইশ অবশ্য বেশ আবেগপূর্ণ কথাবার্তা বলার চেষ্টা করা করেছিল। তার কথায় বা তার লোক দেখানো হাত ধরে ঝাঁকানোয় অন্তত মুখে কোন অপ্রীতিকর ভাব প্রকাশ করিনি। ১৮৬৯ সালে লিভিংস্টোনের সঙ্গে সে যা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারপরে তার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সম্ভাবনায় একটুও দুঃখিত হইনি। আমাকে বারে বারে বলা হয়েছিল যে উন্যানয়েম্বের সবাইকে অনেক অনেক সালাম জানাতে। তবে সে যেমন চেয়েছিল তেমনটা করলে সবাই আমাকে ভয়ানক গাধা ভাবলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ... ...
নিজের চার্টখানা বার করলাম - আমি নিজেই সেটা তৈরি করেছিলাম - তার উপর আমার অটুট ভরসা। উন্যানয়েম্বে যাওয়ার এমন একটা পথ খুঁজে বার করলাম যে পথে একটাও কাপড় নজরানা দিতে হবে না - আর জঙ্গল ছাড়া আর কিছু খারাপ জিনিসও পথে পড়বে না। সেই পথ ধরে চললে ভিনজাদের আর লুঠেরা হহাদের পুরো এড়ানো যায়। আর এই শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ পথটি দক্ষিণে চলেছে জলের ধার দিয়ে দিয়ে, উকারাঙ্গা ও উকাওয়েন্দির উপকূল ধরে কেপ টংওয়ে পর্যন্ত। কেপ টংওয়েতে যেখানে পৌঁছব, সেটা উকাওয়েন্দির ইউসাওয়া জেলার ইটাগা, সুলতান ইমরেরা গ্রামের বিপরীতে ; এর পরে আমরা আমাদের পুরানো রাস্তায় পড়ব। যে রাস্তা ধরে আমি উজিজি যাওয়ার জন্য উন্যানয়েম্বে থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম। ডাক্তারকে এই রাস্তার কথা বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই এর সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যাপারটা বুঝলেন; আর যদি আমরা ইমরেরায় পৌঁছাই, আমার যেমন মনে হয়েছিল, তাহলে তো প্রমাণই হয়ে যাবে যে আমার চার্ট ঠিক না ভুল। ... ...
নিজেদের কালো ভালুক-চামড়া, উজ্জ্বল পারস্য দেশীয় কার্পেট ও পরিষ্কার নতুন মাদুরের উপর গুছিয়ে বসে ভারি আরাম হল। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে আরামসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাদের পিকনিকের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গল্প শুরু হল। লিভিংস্টোন আমাদের রুসিজির যাত্রাকে পিকনিকই বলে থাকেন। মনে হচ্ছিল পুরোন সুখের স্মৃতিচারণ করা দিনগুলো ফিরে এসেছে। যদিও আমাদের বাড়িটা নেহাতই সাধারণ, চাকরবাকরেরাও নেহাতই সামান্য, নগ্ন, বর্বর; তবু উন্যানিয়েম্বে থেকে সেই ঘটনাবহুল যাত্রার পর এই বাড়ির কাছেই আমার লিভিংস্টোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল— এই বারান্দাতে বসেই টাঙ্গানিকা হ্রদের পশ্চিমপারের বহুদূরের, মনোমুগ্ধকর জায়গাগুলোর সম্বন্ধে তাঁর বিস্ময়কর গল্পগুলো শুনেছিলাম; ঠিক এই খানেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়; আর সেই থেকে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েই চলেছে আর তিনি যখন বললেন যে আমার প্রহরায়, আমার খরচে আর আমারই পতাকার তলায় তিনি উন্যানিয়েম্বে যেতে চান, আমি তো সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে গেলাম। ... ...
উভিনজায় ঢুকতেই যে সম্ভাষণ শুনতে পাই তার থেকেই বোঝা যায় যে এক নতুন উপজাতি, নতুন রীতিনীতির সঙ্গে এবার পরিচিত হতে যাচ্ছি। দুজন ভিনজার মধ্যে প্রথম পরিচয় একটি ভয়ানক ক্লান্তিকর ব্যাপার। পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দুহাত বাড়িয়ে দেয় আর ‘‘জাগো, জাগো’’ বলতে থাকে। তারপরে, একে অপরের কনুই আঁকড়ে ধরে হাত ঘষতে থাকে আর দ্রুত বলতে থাকে, ‘‘জাগো, জাগো, জেগে ওঠো, জেগে ওঠো,’’ যার শেষটা হয় "হু, হু" দিয়ে। তাতে পারস্পরিক তৃপ্তি বোঝায়। মেয়েরা এমনকি কাঁচা বয়সের ছেলেদেরও অভিবাদন করে। সামনে পিঠ ঝুঁকিয়ে, আঙ্গুলের ডগা দিয়ে পায়ের আঙ্গুল ছুঁয়ে। অথবা পাশে ঘুরে, হাততালি দিয়ে বলে, ‘‘জাগো, জাগো, জেগে ওঠো, জেগে ওঠো, হুহ, হুহ’’। পুরুষরাও হাততালি দেয় আর একই শব্দে জবাব দেয়। ... ...
গ্রামের মাতৃস্থানীয়রা যখন এটা-ওটা-সেটা নিরীহ কথা কানাকানি করে , তখন পরিবারের কর্তাদের পাওয়া যায় ছেলেদের আড্ডায়। সেখানে জিনিসপত্রের দাম, এলাকার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলে। সম্ভবত আরো অনেকটা সভ্য দেশে একই ধরণের জায়গায় যতটা বিচক্ষণতা ও বোধের সঙ্গে এই ধরণের আলোচনা হয়, এখানকার আলোচনাও সেই একই গোত্রের। কিন্যামওয়েজি গ্রামের সকলের একত্রিত হওয়ার জায়গাকে ওদের ভাষায় "ওয়ানজা" বা উওয়ানজা বলা হয়। এটা সাধারণত গ্রামের চৌকোনো জায়গার একটেরেতে থাকে। ফাঁকা সময়ে- অবশ্য ব্যস্ততা খুব কমই থাকে - তারা উবু হয়ে বসে ধূমপান করে, আর সম্ভবত মায়েদের মুখে একটু আগে যে আলোচনা শোনা গেছে, সেই একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে । সদ্য আগত সাহেবটি হল সেই বিষয় । ... ...
ন্যামওয়েজিদের কিছু অদ্ভুত রীতি আছে। একটা বাচ্চার জন্মের পরে তার বাবা পিতা নাড়িটা কেটে ফেলে আর সেটা নিয়ে রাজ্যের সীমানায় গিয়ে সেখানে মাটিতে পুঁতে দেয়। যদি সে জায়গাটা একটি নদী হয়, তাহলে নদীর পাড়ে পুঁতে দেয়; তারপর একটা গাছের শিকড় নিয়ে সে ফিরে আসে, আর বাড়ি ফিরে নিজের দরজার চৌকাঠে সেটা পুঁতে দেয়। তারপর সে তার বন্ধুদের জন্য একটা ভোজের বন্দোবস্ত করে। একটা বলদ বা গোটা ছয়েক ছাগল মারে, পোম্বে বিলোয় সবাইকে। যমজ সন্তানের জন্ম হলে, তারা কখনই একজনকে মেরে ফেলে না, বরং সেটা আরও বড় আশীর্বাদ মনে করে। ... ...
মধ্য আফ্রিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপজাতি হল ন্যামওয়েজিরা। আমার কাছে একজন ন্যামওয়েজির সৌন্দর্যের আদর্শ হল একজন লম্বা দীর্ঘপদ কালো মানুষ, ভালো মানুষের মতন সদা হাসিভরা মুখ, হাসির ফাঁকে দাঁতের উপরের সারির মাঝখানে একটা ছোট গর্ত দৃশ্যমান। সে যখন বালকমাত্র, তখন তার গোত্র বোঝাতে এই গর্তটা তৈরি করা হয়েছিল। তার গলার থেকে শত শত লম্বা তারের ঝুমকো ঝুলছে; মানুষটা প্রায় নগ্ন হওয়ায় তার গোটা সুন্দর শরীরটা দেখতে কোন অসুবিধা নেই। ... ...